ভালোবাসার উপন্যাস ----জান্নাতুল মমি।
Admin:
ভালোবাসার উপন্যাস
----জান্নাতুল মমি
.
উইলিয়াম শেকসপিয়রের রোমিও এবং জুলিয়েটের ভালোবাসা যেমন বেঁচে রয়েছে সকলের অন্তরে তেমনই এক ভালোবাসা বেঁচে আছে আমার অন্তরে।আমি একটু একটু করে সে ভালোবাসার যত্ন নেই।একবারেও কাঁদতে দেইনা হারানো ভালোবাসার অনুভূতি গুলোকে।কারন ভালোবাসা গুলো কাঁদুক এ রকম অনুভূতি সত্যিই বাজে।সব ভালোবাসার জয় হোক,সব ভালোবাসা ভালো থাকুক এই একটাই কাম্য আমার।
রাজশাহী রেল স্টেশনে বসে আছি প্রায় এক ঘন্টা যাবৎ ধরে।প্রতিবারের ন্যায় এবারেও ট্রেন তার প্লাটফর্মে পৌঁছার অনেক আগেই আমি হাজির হয়ে গেছি স্টেশনে।সম্ভবত তা অভ্যাসে পরিণত হয়ে পড়েছে।তাই বেকার এক ঘন্টা সময় হাতে নিয়ে এক বাদাম বিক্রেতার কাছে থেকে পনেরো টাকার বাদাম কিনে চিবুতে লাগলাম।বাদামের খোসাগুলো হাল্কা বলে কি সুন্দর ভাবে খোসাগুলোকে উড়িয়ে দিচ্ছি।কিন্তু এখন আমি খুবই হাল্কা ভাবে জীবন অতিবাহিত করছিনা।কেননা জীবনের কোনো কিছুই এখন সহজ ভাবে নিতে আমি নারাজ।কারন তাতে হারানোর সম্ভবনা থাকে অনেক বেশি।আর আমি আমার জীবন থেকে কোনো কিছু আর হারাতে চাই না।কেননা এক একটা হারানো অনুভূতির তীব্রতা অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক। আর সে তীব্র যন্ত্রনা সহ্য করার মত ক্ষমতা কোনো ভাবেই আমি সঞ্চয় করতে পারবো না।
ঘড়ির কাঁটা যখন সকাল ৮ টা বেজে ৪৭ মিনিট তখন ঢাকাগামী ট্রেনটি এসে ঠিক আমি এতক্ষণ যেখানটায় বসে ছিলাম সেখানটায় এসে দাঁড়ালো।কত মানুষের ভিড় আজ স্টেশনে।আপনজনকে কেউ বা ছেড়ে চলে যাচ্ছে তো আবার কেউ বা ফিরছে নিজের ঘরে।তবে আমার ক্ষেত্রে বরাবরের মতো আজকের বিষয়টি একদমই অন্য।হয়ত এখানে আমিই একমাত্র মানুষ যে কিনা আপনজন কে ছেড়ে নিজ ঘরে ফিরছি।
কত শত মুখ আজ দেখতে পাচ্ছি এখানে।যদিও বা ম্যানেজমেন্ট বা আশেপাশের বিক্রেতা গুলো ছাড়া প্রায় সকল মুখই আমার কাছে অপরিচিত।তবুও তাদের অনুভূতি গুলো আর অপরিচিত নয় আমার কাছে।এ রকম জায়গায় সকলের অনুভূতি কি হতে পারে তা হয়ত সকলেই বুঝে,সকলেই জানে।
.......
ট্রেনের জানালার পাশে আমার সিট ছিল।একটা খবরের কাগজ নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম আগে ভাগেই।চারিদিকে তখন কাঁন্না,আকুতি দেখে অসম্ভব রকম এক খারাপ লাগা অনুভূতি অনুভব করতে লাগলাম।হয়তো এক বছর পর আবারো ফিরতে হবে এ রাজশাহী শহরে।কতো যে কষ্ট আজ রেখে যাচ্ছি পূনরায় এই শহরটির বুকে।
ট্রেন টা ঠিক সময় মতোই ছেড়ে দিল।আমি তখন মিনারেল পানির বোতলের মুখ টা খুলে এক বার মুখের মধ্যে পানি ঢেলে দিলাম।তখন এক জন ভদ্রলোক স্ত্রী,বাচ্চা সহ আমাকে এসে তাদের টিকিট ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তাদের সিট টা কোনদিকে!!
আমি হেসে তাদের উত্তর দিলাম আমার মুখোমুখি বসে পড়ুন।আপনাদের সিট আমার সামনেই।ভদ্রলোকটি তখন আমাকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে তার পরিবারসহ আমার সামনেই বসে পড়লেন।
.......
কিছুদূর ট্রেনটি এগিয়ে গেল।আমি খবরের কাগজে মুখ গুজিয়ে খবর পড়ছিলাম তখন ভদ্র লোকটির ছোট ছেলে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,আঙ্কেল ঢাকা কতদূর?
আমরা আজ প্রথম ঢাকা যাচ্ছি।
আমি বললাম খুব বেশি দূরে না বাবু।এইতো পৌঁছে গেলাম বলে।তুমি চকলেট খেতে থাকো দেখবে এক নিমিষেই আমরা ঢাকায় চলে যাবো।ছেলেটি আমাকে একটা হাসি দিয়ে মায়ের কোলে গিয়ে বসে পড়লো।আসলে ছোট বাচ্চাগুলোকে কত ভাবেই না বুঝ দেওয়া সম্ভব।আর সে বুঝ তারা সত্য বলে মেনেও নেয়।কিন্তু আমরা বড়রা!!আমাদের যে বুঝার বয়স হয়েছে।কোনটা ঠিক কোনটা ভুল আমরা বুঝতে পারি।তবুও কিছু মানুষ আছে যাদের বুঝ দিয়েও লাভ হয় না।আমিও ঠিক তাদের দলে।
......
ঘন্টা দুয়েক যাওয়ার পর ভদ্রলোকটির ছেলে মায়ের কোলেই ঘুমিয়ে পড়লো।এ দু ঘন্টা বেশ জ্বালিয়েছে আমাকে সে।তবুও আমি কোনো রকম রাগ দেখাই নি তাকে।কারন বাচ্চা বরাবরই আমার কাছে প্রিয়।আর চার বছর আগে থেকে এ বাচ্চাগুলো কেনো জানি না আরো বেশি ভালো লাগতে শুরু করেছিল।হয়তো মায়া নয়ত পিছুটান।হবে হয়তো কোনো একটা।তবে বাচ্চা যে প্রিয় এইটা সত্য আমার জীবনে।
......
ট্রেনের জানালা টা খুলে দিলাম।মিষ্টি বাতাসে চোখ টা কেমন জানি আমারো বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো।আমি কেমন জানি তখন এক মেয়েকে স্বপ্নের রংতুলিতে আঁকতে লাগলাম।এ মেয়েটা অনেকবারই আমার স্বপ্নে এসেছিল।এখনো আসে।
.......
নিহাল ভাইয়া,আপনাকে সব সময় আমাদের বাসার সামনে দেখতে পাই কেনো?
--কই দেখলে?আমি তো কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁডিয়ে থাকি প্রতিদিন।
---সে কৃষ্ণচূড়া গাছটা কিন্তু আমাদের বাসার সামনেই।
--ওহ তাই বুঝি?আমি জানতাম না তো ঐখানেই তোমাদের বাসা।আচ্ছা কোন বাসা টা?একদিন তোমাদের বাসায় যাবো।নিয়ে যাবে তো?
--ঢং করেন কেনো নিহাল ভাইয়া?ছেলেদের ঢং একদম মানায় না কিন্তু!
--হুম,বুঝেছি আন্টি আঙ্কেল বকবে বাসায় গেলে তাই তুমি নিয়ে যেতে চাচ্ছো না।ঠিক ধরেছি না?
--আমার মুন্ডু বুঝেছেন।আচ্ছা আপনি সব সময় আমার সাথে এতো রহস্য করে কথা বলেন কেনো?জানেনই তো আমি রহস্য একদম পছন্দ করি না।
--আচ্ছা বাবা স্যরি।এখন বলো কোনো নোট লাগবে কি তোমার?
--না এখন লাগবে না।তাছাড়া গত দিনের টেকনোলজিরর যে নোট দিয়েছেন সেটাই এখনো বুঝা বাকি আছে।
---হাহাহাহা।আচ্ছা সমস্যা নেই।কাল ইউনিভার্সিটি তে এসো তোমাকে বুঝিয়ে দিবো তখন।এখন যাও।সামনে তো পরীক্ষা ভালো করে পড়ো।
--আচ্ছা, ভাইয়া এখন তাহলে আসি।আর হ্যাঁ ঐ যে ১২ তলা ফ্ল্যাট দেখছেন তার ৬ তলায় আমি থাকি।আর আমার বাসায় গেলে আব্বু বা আম্মু কেউই বকবে না।বুঝেছেন এইবার??
--হ্যাঁ খুব বুঝেছি।
.....
আমি প্রেম,ভালোবাসায় খুব একটা আগ্রহী না।তবে মিতা মেয়েটি আমাকে ভালোবাসা কি তা শিখালো।আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করালো।এই মেয়েটি তখন আমার মনে সারাটি দিন আনাগোনা করতে থাকলো।মিথ্যে প্রয়োজনের কথা বলে তার বাসার সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে থাকতাম প্রতিদিন।মিতা হয়তো প্রথম দিকে বুঝতো না কিছু।কিন্তু যেদিন থেকে তার বাসার সামনে গিয়ে প্রতিদিন একটা করে গোলাপ তাকে দিতে লাগলাম তখন সে হয়ত আমার মনের কথা গুলো বুঝতে পেরেছিল।তখন কেনো জানি আমারও মনে হলো মিতাও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু কোনো দিন কেউ কাউকেই বলতে পারলাম না আমাদের মনের কথাগুলো।শুধু ভালোবাসা নোট দেওয়া নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলো।কিন্তু আমাদের এ ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত লুকিয়ে রাখা আর সম্ভব হলো না।
আমার আঙ্গুল গুলো সব সময় মিতার আঙ্গুলের ভিতর থাকতো।আমার ভালোবাসা যেমন মিতাকে প্রতিনিয়ত খুঁজতো তেমন এ অনুভূতি মিতারও ছিল।তারপর একসাথে শুরু হলো আমাদের ভালোবাসার এক উপন্যাস।হুম উপন্যাসই বটে।মিতা হলো আমার সেই ভালোবাসা উপন্যাসের নায়িকা।আবার মূল চরিত্রও বটে।
.....
মিতা আর আমি দুজনই ঢাকা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। শুধু তাই না একই ডিপার্টমেন্টে পড়তাম আমরা।তবে মিতা অবশ্য আমার এক বছরের জুনিয়র ছিল।তাই মিতার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার এক বছর আগে আমি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে ফেলি।তারপর একটা চাকরির খোঁজে লেগে পড়ি। মিতার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার আগেই আমি ভালো একটা চাকরি পেয়েও গেলাম।তারপর শুধু অপেক্ষায় ছিলাম আমাদের ভালোবাসা লোক সমাজে স্বীকৃতি পাওয়ার।মিতাও তার গ্রাজুয়েশন শেষ করে তার বাসায় আমার কথা বলেছিল।একটাই মেয়ে ছিল বিধায় উনারা হয়ত আর না করতে পারেন নি আমাকে।মিতাদের পৈত্রিক বাসা রাজশাহী শহরে ছিল।মিতার গ্রাজুয়েশনের জন্য তার বাবা মা মিতাকে নিয়ে ঢাকায় আসে।তাই মিতার বাবা প্রস্তাব দিলেন কনে যাত্রী রাজশাহী থেকেই আসবে।যদি আমাদের খুব বেশি সমস্যা না থাকে তাহলে বর যাত্রী ঢাকা থেকে রাজশাহী তে যাওয়ার অনুরোধ করলেন।আমি এতে খুব বেশি চেঁচামেচি করি নি।কারন আমি শুধু মিতাকেই চাই।আর তারজন্য আমাকে সে রাজশাহীই যেতে হোক বা টেকনাফ, তেঁতুলিয়া কোনো প্রকার সমস্যা নেই আমার।
দুই পক্ষের মতের মিল অমিলের ধাক্কা পার হয়ে একটা দিন ধার্য করা হলো আমাদের বিয়ের।যেমন খুশি ছিলাম আমি তেমনই খুশি ছিল মিতাও।
দুজন মিলে দিন গুনতে গুনতে বিয়ের দিন এসে পড়লো আমাদের ।বর পক্ষ গেল রাজশাহী তে বউ আনতে।সেদিন টা কোনো ভাবেই ভুলবার নয়।আমি যেন মিতাকে খুব কাছে থেকে দেখছি।হয়ত ভালোবাসা পূর্ণতা পেলে সে খুশি বাঁধ ভেঙ্গে পড়ে মনের আঁনাচে কাঁনাচে।বিকেল ৪টা বেজে ৭ মিনিটে বৈধ ভাবে আমি মিতাকে আমার করে নিলাম কবুল পড়ে।সত্যিই এক ভালো লাগা অনুভূতি ছিল।
.....
মিষ্টি ভালোবাসায় চলছিল আমার আর মিতার সংসার।খুনসুটি অভিমানও জমতো আমাদের মধ্যে।আর কোন সংসারেই বা রাগ অভিমান নেই!!!তবুও সে রাগ অভিমান গুলো কে আমরা আমাদের মনে পুষে রাখতাম না।আমাদের ভালোবাসা দিয়েই সে মান অভিমান গুলো কে চাপা দিয়ে দিতাম।শুধু ভালোবাসাই ছিল আমাদের ভালোবাসা উপন্যাসের মূল উপজীব্য।
.....
সংসারের দুটি বছর পার হয়ে গেল।একদিন মিতা আমাকে সবচেয়ে বড় খুশির সংবাদ দেয়।আমি নাকি বাবা হতে চলেছি।একটা ছোট্ট অস্তিত্ব মিতার ভিতর বেড়ে উঠছে।সত্যিই এ অনুভূতিও যে ব্যক্ত করার মতো না।আসলেই যেন সেদিন আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম।
......
আরো কেটে গেল কয়েকমাস।মেয়েদের প্রথম সন্তান নাকি বাবার বাড়ি হয়।তাই মিতারও শখ জেগেছে তার প্রথম সন্তান যেন রাজশাহী তে হয়।আমিও তার কথা মেনে নিলাম।সব কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে মিতাকে নিয়ে চলে গেলাম রাজশাহী। ডাক্তাররা ডেলিভারি হওয়ার সম্ভাব্য তারিখও দিয়েছে।খুব ভয় করতো মিতার।সব সময় আমাকে কাছে কাছে থাকতে বলতো সে।আমিও তার সাথেই থাকতাম সব সময়।মাঝে মাঝে মিতা বলতো তার পেটে নাকি সে ছোট্ট শিশুটি নড়াচড়া করে উঠতো।আর আমি তখন কান পেতে তার শব্দ শুনতাম।সম্ভাব্য তারিখের আগেই একদিন মিতার পেটের ব্যথা উঠে।দ্রুত এম্বুলেন্স নিয়ে আসা হলো।রাস্তায় সেদিন খুব ভিড় ছিল।আমি মিতার পাশেই বসে ছিলাম কিন্তু রাস্তার বেগতিক অবস্থা দেখে নিজেই রাস্তায় নেমে পড়লাম যেন তাড়াতাড়ি গাড়ি গুলোকে সড়িয়ে আমরা হাসপাতালে পৌঁছাতে পারি।মিতা অনেক বার আমাকে ওর হাত ছাড়তে নিষেধ করেছিল।কিন্তু আমি ওর হাত ছেড়ে দিয়েছিলাম।
হঠাৎই এক চলন্ত বাস তার ব্রেক হারিয়ে আমাদের এম্বুলেন্সের পিছন টায় ধাক্কা মারলো।ব্যস্ত রাস্তা যেন তখন থমকে গেল।সবার চোখ একদিকে চেয়ে রইলো।নির্বাক হয়ে রইলো সকলে।মূহুর্তেই এম্বুলেন্স উলটিয়ে গেল, আর বাসটি সজোরে এক দেওয়ালে গিয়ে আঘাত করলো।আমি দৌঁড়ে গেলাম আমার মিতার কাছে।প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল তখন মিতার।মিতার বাবা, মা এবং এম্বুলেন্সে থাকা আরো দুজন আহত হলো।দ্রুত আরেকটি গাড়ি করে মিতাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো।কিন্তু আমার জীবনের সুখের বাতি যেন সেদিনই নিভে গেল।জরুরী ভিত্তিতে মিতাকে অপারেশনে নেওয়া হলেও আমি মিতা বা আমার বাচ্চা কাউকেই জীবিত অবস্থায় ফিরে পাইনি।খুব আফসোস করি কেনোই বা সেদিন মিতার হাত টি আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম।আমার এই একাকীত্ব জীবনের জন্য কি?আমি শুধু সেদিন মিতা কে না আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার আমিকে।আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ আমার ভালোবাসাকে।আমি হারিয়ে ফেলেছি সে ছোট্ট শিশুকে যাকে নিয়ে অনেক কিছুই কল্পনা করে বসে ছিলাম।আমাকে যেন এ যন্ত্রনা গুলো বার বার কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।তবুও কিছুই করার নেই।এক বুক দীর্ঘশ্বাসই যেন আমার সঙ্গী।
মাঝে মাঝেই মিতা আর আর আমার অনাগত সন্তানের মুখ টি ভেসে উঠে।প্রত্যেক সকালে মিতাই যেন আমাকে ডেকে তুলে নিহাল নিহাল বলে চিৎকার করে।আর আজ মনে হয় শুনতে পাচ্ছি আমার সে সন্তানটি আমাকে বাবা বলে ডেকে বলছে--উঠো বাবা, আর কতো ঘুমোবে??
হঠাৎই আমি চমকে উঠলাম।চোখ দুটো খুলে দেখতে পেলাম ট্রেনের মুখোমুখি বসা ভদ্রলোকটির ছেলে আমার শরীরকে অনবরত ঝাঁকিয়েই চলেছে আর বলছে আঙ্কেল চলে এসেছি ঢাকা।আমি তখন চারপাশে তাকিয়ে দেখি সত্যিই কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের সামনে ট্রেনটি দাঁড়িয়ে আছে।তারপর সে ভদ্রলোকটিসহ তার ছেলে কে বিদায় দিয়ে রিক্সা করে বাড়ি ফিরছিলাম।আবার হয়তো যাবো রাজশাহী শহরে আগামী বছর আজকের এই দিনটিতে।কারন রাজশাহীর মাটির কবরেই যে শুয়ে রয়েছে আমার মিতা এবং আমার সন্তান।দুজনেরই মৃত্যু বার্ষিকী আজ।১০ ফেব্রুয়ারি তারিখটি আমার জীবনে অক্ষয় হয়ে থাকবে।বেঁচে থাকবে আমার ভালোবাসায় মিতা আর আমার সন্তান।যদিও বা মা আরেকটি বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে আমার।তবে আমার প্রথম ভালোবাসা বা ভালোলাগার অনুভূতি গুলো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না কোনোদিন।কারন আমার জীবনে ভালোবাসার উপন্যাস একটাই।
ভালোবাসার উপন্যাস
----জান্নাতুল মমি
.
উইলিয়াম শেকসপিয়রের রোমিও এবং জুলিয়েটের ভালোবাসা যেমন বেঁচে রয়েছে সকলের অন্তরে তেমনই এক ভালোবাসা বেঁচে আছে আমার অন্তরে।আমি একটু একটু করে সে ভালোবাসার যত্ন নেই।একবারেও কাঁদতে দেইনা হারানো ভালোবাসার অনুভূতি গুলোকে।কারন ভালোবাসা গুলো কাঁদুক এ রকম অনুভূতি সত্যিই বাজে।সব ভালোবাসার জয় হোক,সব ভালোবাসা ভালো থাকুক এই একটাই কাম্য আমার।
রাজশাহী রেল স্টেশনে বসে আছি প্রায় এক ঘন্টা যাবৎ ধরে।প্রতিবারের ন্যায় এবারেও ট্রেন তার প্লাটফর্মে পৌঁছার অনেক আগেই আমি হাজির হয়ে গেছি স্টেশনে।সম্ভবত তা অভ্যাসে পরিণত হয়ে পড়েছে।তাই বেকার এক ঘন্টা সময় হাতে নিয়ে এক বাদাম বিক্রেতার কাছে থেকে পনেরো টাকার বাদাম কিনে চিবুতে লাগলাম।বাদামের খোসাগুলো হাল্কা বলে কি সুন্দর ভাবে খোসাগুলোকে উড়িয়ে দিচ্ছি।কিন্তু এখন আমি খুবই হাল্কা ভাবে জীবন অতিবাহিত করছিনা।কেননা জীবনের কোনো কিছুই এখন সহজ ভাবে নিতে আমি নারাজ।কারন তাতে হারানোর সম্ভবনা থাকে অনেক বেশি।আর আমি আমার জীবন থেকে কোনো কিছু আর হারাতে চাই না।কেননা এক একটা হারানো অনুভূতির তীব্রতা অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক। আর সে তীব্র যন্ত্রনা সহ্য করার মত ক্ষমতা কোনো ভাবেই আমি সঞ্চয় করতে পারবো না।
ঘড়ির কাঁটা যখন সকাল ৮ টা বেজে ৪৭ মিনিট তখন ঢাকাগামী ট্রেনটি এসে ঠিক আমি এতক্ষণ যেখানটায় বসে ছিলাম সেখানটায় এসে দাঁড়ালো।কত মানুষের ভিড় আজ স্টেশনে।আপনজনকে কেউ বা ছেড়ে চলে যাচ্ছে তো আবার কেউ বা ফিরছে নিজের ঘরে।তবে আমার ক্ষেত্রে বরাবরের মতো আজকের বিষয়টি একদমই অন্য।হয়ত এখানে আমিই একমাত্র মানুষ যে কিনা আপনজন কে ছেড়ে নিজ ঘরে ফিরছি।
কত শত মুখ আজ দেখতে পাচ্ছি এখানে।যদিও বা ম্যানেজমেন্ট বা আশেপাশের বিক্রেতা গুলো ছাড়া প্রায় সকল মুখই আমার কাছে অপরিচিত।তবুও তাদের অনুভূতি গুলো আর অপরিচিত নয় আমার কাছে।এ রকম জায়গায় সকলের অনুভূতি কি হতে পারে তা হয়ত সকলেই বুঝে,সকলেই জানে।
.......
ট্রেনের জানালার পাশে আমার সিট ছিল।একটা খবরের কাগজ নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম আগে ভাগেই।চারিদিকে তখন কাঁন্না,আকুতি দেখে অসম্ভব রকম এক খারাপ লাগা অনুভূতি অনুভব করতে লাগলাম।হয়তো এক বছর পর আবারো ফিরতে হবে এ রাজশাহী শহরে।কতো যে কষ্ট আজ রেখে যাচ্ছি পূনরায় এই শহরটির বুকে।
ট্রেন টা ঠিক সময় মতোই ছেড়ে দিল।আমি তখন মিনারেল পানির বোতলের মুখ টা খুলে এক বার মুখের মধ্যে পানি ঢেলে দিলাম।তখন এক জন ভদ্রলোক স্ত্রী,বাচ্চা সহ আমাকে এসে তাদের টিকিট ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তাদের সিট টা কোনদিকে!!
আমি হেসে তাদের উত্তর দিলাম আমার মুখোমুখি বসে পড়ুন।আপনাদের সিট আমার সামনেই।ভদ্রলোকটি তখন আমাকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে তার পরিবারসহ আমার সামনেই বসে পড়লেন।
.......
কিছুদূর ট্রেনটি এগিয়ে গেল।আমি খবরের কাগজে মুখ গুজিয়ে খবর পড়ছিলাম তখন ভদ্র লোকটির ছোট ছেলে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,আঙ্কেল ঢাকা কতদূর?
আমরা আজ প্রথম ঢাকা যাচ্ছি।
আমি বললাম খুব বেশি দূরে না বাবু।এইতো পৌঁছে গেলাম বলে।তুমি চকলেট খেতে থাকো দেখবে এক নিমিষেই আমরা ঢাকায় চলে যাবো।ছেলেটি আমাকে একটা হাসি দিয়ে মায়ের কোলে গিয়ে বসে পড়লো।আসলে ছোট বাচ্চাগুলোকে কত ভাবেই না বুঝ দেওয়া সম্ভব।আর সে বুঝ তারা সত্য বলে মেনেও নেয়।কিন্তু আমরা বড়রা!!আমাদের যে বুঝার বয়স হয়েছে।কোনটা ঠিক কোনটা ভুল আমরা বুঝতে পারি।তবুও কিছু মানুষ আছে যাদের বুঝ দিয়েও লাভ হয় না।আমিও ঠিক তাদের দলে।
......
ঘন্টা দুয়েক যাওয়ার পর ভদ্রলোকটির ছেলে মায়ের কোলেই ঘুমিয়ে পড়লো।এ দু ঘন্টা বেশ জ্বালিয়েছে আমাকে সে।তবুও আমি কোনো রকম রাগ দেখাই নি তাকে।কারন বাচ্চা বরাবরই আমার কাছে প্রিয়।আর চার বছর আগে থেকে এ বাচ্চাগুলো কেনো জানি না আরো বেশি ভালো লাগতে শুরু করেছিল।হয়তো মায়া নয়ত পিছুটান।হবে হয়তো কোনো একটা।তবে বাচ্চা যে প্রিয় এইটা সত্য আমার জীবনে।
......
ট্রেনের জানালা টা খুলে দিলাম।মিষ্টি বাতাসে চোখ টা কেমন জানি আমারো বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো।আমি কেমন জানি তখন এক মেয়েকে স্বপ্নের রংতুলিতে আঁকতে লাগলাম।এ মেয়েটা অনেকবারই আমার স্বপ্নে এসেছিল।এখনো আসে।
.......
নিহাল ভাইয়া,আপনাকে সব সময় আমাদের বাসার সামনে দেখতে পাই কেনো?
--কই দেখলে?আমি তো কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁডিয়ে থাকি প্রতিদিন।
---সে কৃষ্ণচূড়া গাছটা কিন্তু আমাদের বাসার সামনেই।
--ওহ তাই বুঝি?আমি জানতাম না তো ঐখানেই তোমাদের বাসা।আচ্ছা কোন বাসা টা?একদিন তোমাদের বাসায় যাবো।নিয়ে যাবে তো?
--ঢং করেন কেনো নিহাল ভাইয়া?ছেলেদের ঢং একদম মানায় না কিন্তু!
--হুম,বুঝেছি আন্টি আঙ্কেল বকবে বাসায় গেলে তাই তুমি নিয়ে যেতে চাচ্ছো না।ঠিক ধরেছি না?
--আমার মুন্ডু বুঝেছেন।আচ্ছা আপনি সব সময় আমার সাথে এতো রহস্য করে কথা বলেন কেনো?জানেনই তো আমি রহস্য একদম পছন্দ করি না।
--আচ্ছা বাবা স্যরি।এখন বলো কোনো নোট লাগবে কি তোমার?
--না এখন লাগবে না।তাছাড়া গত দিনের টেকনোলজিরর যে নোট দিয়েছেন সেটাই এখনো বুঝা বাকি আছে।
---হাহাহাহা।আচ্ছা সমস্যা নেই।কাল ইউনিভার্সিটি তে এসো তোমাকে বুঝিয়ে দিবো তখন।এখন যাও।সামনে তো পরীক্ষা ভালো করে পড়ো।
--আচ্ছা, ভাইয়া এখন তাহলে আসি।আর হ্যাঁ ঐ যে ১২ তলা ফ্ল্যাট দেখছেন তার ৬ তলায় আমি থাকি।আর আমার বাসায় গেলে আব্বু বা আম্মু কেউই বকবে না।বুঝেছেন এইবার??
--হ্যাঁ খুব বুঝেছি।
.....
আমি প্রেম,ভালোবাসায় খুব একটা আগ্রহী না।তবে মিতা মেয়েটি আমাকে ভালোবাসা কি তা শিখালো।আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করালো।এই মেয়েটি তখন আমার মনে সারাটি দিন আনাগোনা করতে থাকলো।মিথ্যে প্রয়োজনের কথা বলে তার বাসার সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে থাকতাম প্রতিদিন।মিতা হয়তো প্রথম দিকে বুঝতো না কিছু।কিন্তু যেদিন থেকে তার বাসার সামনে গিয়ে প্রতিদিন একটা করে গোলাপ তাকে দিতে লাগলাম তখন সে হয়ত আমার মনের কথা গুলো বুঝতে পেরেছিল।তখন কেনো জানি আমারও মনে হলো মিতাও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু কোনো দিন কেউ কাউকেই বলতে পারলাম না আমাদের মনের কথাগুলো।শুধু ভালোবাসা নোট দেওয়া নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলো।কিন্তু আমাদের এ ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত লুকিয়ে রাখা আর সম্ভব হলো না।
আমার আঙ্গুল গুলো সব সময় মিতার আঙ্গুলের ভিতর থাকতো।আমার ভালোবাসা যেমন মিতাকে প্রতিনিয়ত খুঁজতো তেমন এ অনুভূতি মিতারও ছিল।তারপর একসাথে শুরু হলো আমাদের ভালোবাসার এক উপন্যাস।হুম উপন্যাসই বটে।মিতা হলো আমার সেই ভালোবাসা উপন্যাসের নায়িকা।আবার মূল চরিত্রও বটে।
.....
মিতা আর আমি দুজনই ঢাকা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। শুধু তাই না একই ডিপার্টমেন্টে পড়তাম আমরা।তবে মিতা অবশ্য আমার এক বছরের জুনিয়র ছিল।তাই মিতার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার এক বছর আগে আমি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে ফেলি।তারপর একটা চাকরির খোঁজে লেগে পড়ি। মিতার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার আগেই আমি ভালো একটা চাকরি পেয়েও গেলাম।তারপর শুধু অপেক্ষায় ছিলাম আমাদের ভালোবাসা লোক সমাজে স্বীকৃতি পাওয়ার।মিতাও তার গ্রাজুয়েশন শেষ করে তার বাসায় আমার কথা বলেছিল।একটাই মেয়ে ছিল বিধায় উনারা হয়ত আর না করতে পারেন নি আমাকে।মিতাদের পৈত্রিক বাসা রাজশাহী শহরে ছিল।মিতার গ্রাজুয়েশনের জন্য তার বাবা মা মিতাকে নিয়ে ঢাকায় আসে।তাই মিতার বাবা প্রস্তাব দিলেন কনে যাত্রী রাজশাহী থেকেই আসবে।যদি আমাদের খুব বেশি সমস্যা না থাকে তাহলে বর যাত্রী ঢাকা থেকে রাজশাহী তে যাওয়ার অনুরোধ করলেন।আমি এতে খুব বেশি চেঁচামেচি করি নি।কারন আমি শুধু মিতাকেই চাই।আর তারজন্য আমাকে সে রাজশাহীই যেতে হোক বা টেকনাফ, তেঁতুলিয়া কোনো প্রকার সমস্যা নেই আমার।
দুই পক্ষের মতের মিল অমিলের ধাক্কা পার হয়ে একটা দিন ধার্য করা হলো আমাদের বিয়ের।যেমন খুশি ছিলাম আমি তেমনই খুশি ছিল মিতাও।
দুজন মিলে দিন গুনতে গুনতে বিয়ের দিন এসে পড়লো আমাদের ।বর পক্ষ গেল রাজশাহী তে বউ আনতে।সেদিন টা কোনো ভাবেই ভুলবার নয়।আমি যেন মিতাকে খুব কাছে থেকে দেখছি।হয়ত ভালোবাসা পূর্ণতা পেলে সে খুশি বাঁধ ভেঙ্গে পড়ে মনের আঁনাচে কাঁনাচে।বিকেল ৪টা বেজে ৭ মিনিটে বৈধ ভাবে আমি মিতাকে আমার করে নিলাম কবুল পড়ে।সত্যিই এক ভালো লাগা অনুভূতি ছিল।
.....
মিষ্টি ভালোবাসায় চলছিল আমার আর মিতার সংসার।খুনসুটি অভিমানও জমতো আমাদের মধ্যে।আর কোন সংসারেই বা রাগ অভিমান নেই!!!তবুও সে রাগ অভিমান গুলো কে আমরা আমাদের মনে পুষে রাখতাম না।আমাদের ভালোবাসা দিয়েই সে মান অভিমান গুলো কে চাপা দিয়ে দিতাম।শুধু ভালোবাসাই ছিল আমাদের ভালোবাসা উপন্যাসের মূল উপজীব্য।
.....
সংসারের দুটি বছর পার হয়ে গেল।একদিন মিতা আমাকে সবচেয়ে বড় খুশির সংবাদ দেয়।আমি নাকি বাবা হতে চলেছি।একটা ছোট্ট অস্তিত্ব মিতার ভিতর বেড়ে উঠছে।সত্যিই এ অনুভূতিও যে ব্যক্ত করার মতো না।আসলেই যেন সেদিন আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম।
......
আরো কেটে গেল কয়েকমাস।মেয়েদের প্রথম সন্তান নাকি বাবার বাড়ি হয়।তাই মিতারও শখ জেগেছে তার প্রথম সন্তান যেন রাজশাহী তে হয়।আমিও তার কথা মেনে নিলাম।সব কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে মিতাকে নিয়ে চলে গেলাম রাজশাহী। ডাক্তাররা ডেলিভারি হওয়ার সম্ভাব্য তারিখও দিয়েছে।খুব ভয় করতো মিতার।সব সময় আমাকে কাছে কাছে থাকতে বলতো সে।আমিও তার সাথেই থাকতাম সব সময়।মাঝে মাঝে মিতা বলতো তার পেটে নাকি সে ছোট্ট শিশুটি নড়াচড়া করে উঠতো।আর আমি তখন কান পেতে তার শব্দ শুনতাম।সম্ভাব্য তারিখের আগেই একদিন মিতার পেটের ব্যথা উঠে।দ্রুত এম্বুলেন্স নিয়ে আসা হলো।রাস্তায় সেদিন খুব ভিড় ছিল।আমি মিতার পাশেই বসে ছিলাম কিন্তু রাস্তার বেগতিক অবস্থা দেখে নিজেই রাস্তায় নেমে পড়লাম যেন তাড়াতাড়ি গাড়ি গুলোকে সড়িয়ে আমরা হাসপাতালে পৌঁছাতে পারি।মিতা অনেক বার আমাকে ওর হাত ছাড়তে নিষেধ করেছিল।কিন্তু আমি ওর হাত ছেড়ে দিয়েছিলাম।
হঠাৎই এক চলন্ত বাস তার ব্রেক হারিয়ে আমাদের এম্বুলেন্সের পিছন টায় ধাক্কা মারলো।ব্যস্ত রাস্তা যেন তখন থমকে গেল।সবার চোখ একদিকে চেয়ে রইলো।নির্বাক হয়ে রইলো সকলে।মূহুর্তেই এম্বুলেন্স উলটিয়ে গেল, আর বাসটি সজোরে এক দেওয়ালে গিয়ে আঘাত করলো।আমি দৌঁড়ে গেলাম আমার মিতার কাছে।প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল তখন মিতার।মিতার বাবা, মা এবং এম্বুলেন্সে থাকা আরো দুজন আহত হলো।দ্রুত আরেকটি গাড়ি করে মিতাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো।কিন্তু আমার জীবনের সুখের বাতি যেন সেদিনই নিভে গেল।জরুরী ভিত্তিতে মিতাকে অপারেশনে নেওয়া হলেও আমি মিতা বা আমার বাচ্চা কাউকেই জীবিত অবস্থায় ফিরে পাইনি।খুব আফসোস করি কেনোই বা সেদিন মিতার হাত টি আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম।আমার এই একাকীত্ব জীবনের জন্য কি?আমি শুধু সেদিন মিতা কে না আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার আমিকে।আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ আমার ভালোবাসাকে।আমি হারিয়ে ফেলেছি সে ছোট্ট শিশুকে যাকে নিয়ে অনেক কিছুই কল্পনা করে বসে ছিলাম।আমাকে যেন এ যন্ত্রনা গুলো বার বার কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।তবুও কিছুই করার নেই।এক বুক দীর্ঘশ্বাসই যেন আমার সঙ্গী।
মাঝে মাঝেই মিতা আর আর আমার অনাগত সন্তানের মুখ টি ভেসে উঠে।প্রত্যেক সকালে মিতাই যেন আমাকে ডেকে তুলে নিহাল নিহাল বলে চিৎকার করে।আর আজ মনে হয় শুনতে পাচ্ছি আমার সে সন্তানটি আমাকে বাবা বলে ডেকে বলছে--উঠো বাবা, আর কতো ঘুমোবে??
হঠাৎই আমি চমকে উঠলাম।চোখ দুটো খুলে দেখতে পেলাম ট্রেনের মুখোমুখি বসা ভদ্রলোকটির ছেলে আমার শরীরকে অনবরত ঝাঁকিয়েই চলেছে আর বলছে আঙ্কেল চলে এসেছি ঢাকা।আমি তখন চারপাশে তাকিয়ে দেখি সত্যিই কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের সামনে ট্রেনটি দাঁড়িয়ে আছে।তারপর সে ভদ্রলোকটিসহ তার ছেলে কে বিদায় দিয়ে রিক্সা করে বাড়ি ফিরছিলাম।আবার হয়তো যাবো রাজশাহী শহরে আগামী বছর আজকের এই দিনটিতে।কারন রাজশাহীর মাটির কবরেই যে শুয়ে রয়েছে আমার মিতা এবং আমার সন্তান।দুজনেরই মৃত্যু বার্ষিকী আজ।১০ ফেব্রুয়ারি তারিখটি আমার জীবনে অক্ষয় হয়ে থাকবে।বেঁচে থাকবে আমার ভালোবাসায় মিতা আর আমার সন্তান।যদিও বা মা আরেকটি বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে আমার।তবে আমার প্রথম ভালোবাসা বা ভালোলাগার অনুভূতি গুলো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না কোনোদিন।কারন আমার জীবনে ভালোবাসার উপন্যাস একটাই।
No comments
https://web.facebook.com/Newprojapotibd/